মানবতার প্রথম-প্রধান এবং একমাত্র উপাদান মানুষ। এ নিয়ে ত্রয়োদশ শতকে বাংলাদেশে শুরু করেছিলেন বঙ্গ সন্তান চন্ডীদাস আর বিংশ শতাব্দীতে রূপায়িত হয়েছে নজরুলের হাতে। মানবতাবাদ মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার এক অনন্য চিত্র। এটি আমাদের আত্মাকে উজ্জীবিত করে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উজ্জ্বল পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়। এটি একটি শাশ্বত আহ্বান: মানুষ হও, মানবতার সেবক হও।
মানবতাবাদ—একটি শব্দ যা মানুষের আত্মা ও বুদ্ধির উচ্চতাকে ধারণ করে। এটি কেবল একটি দার্শনিক ধারণা নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তি। এই শব্দটি ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়েছে, প্রতিবারই একটি সাধারণ উদ্দেশ্য বহন করে: মানব জাতির উন্নতি এবং মঙ্গল।
মানবতাবাদ হলো একটি আদর্শ, যা মানুষের জ্ঞান, যুক্তি, নৈতিকতা এবং স্বাধীন ইচ্ছার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটি অতিপ্রাকৃত শক্তি এবং অলৌকিকতাকে অস্বীকার করে মানবজাতির কল্যাণে কার্যকর হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যায়। তবে এই ধারণাটি কোথা থেকে এসেছে? মানবতাবাদের ধারণা কীভাবে সময়ের সাথে বিকশিত হয়েছে?
"মানবতাবাদ" শব্দটির প্রথম প্রচলিত রূপ দেখা যায় মুসলিম স্বর্ণযুগে, বিশেষত আন্দালুসিয়ার স্পেনে। অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়ে, মুসলিম দার্শনিক এবং জ্ঞানীরা মানুষের জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির উন্নয়নে অভূতপূর্ব অবদান রাখেন। এই সময়েই প্রথমবারের মতো মানুষের স্বাভাবিক ক্ষমতা এবং মেধাকে অতিপ্রাকৃত শক্তি থেকে আলাদা করে দেখার প্রচেষ্টা চালানো হয়।
ইবনে রুশদ (অ্যাভেরোয়েস) এবং ইবনে সিনার (আভিসেনা) মতো মুসলিম দার্শনিকেরা গ্রিক দর্শনের সঙ্গে ইসলামী চিন্তার সমন্বয় সাধন করেন। তারা যুক্তি, বিজ্ঞান এবং মননশীলতার ওপর জোর দেন, যা পরবর্তী সময়ে ইউরোপের রেনেসাঁ মানবতাবাদের ভিত্তি গড়ে তোলে। আন্দালুসিয়ায় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রগুলি—যেমন কর্ডোভার বিখ্যাত গ্রন্থাগার—মানবতাবাদের শিকড় রোপণ করেছিল, যা পরবর্তীতে পাশ্চাত্য দার্শনিক ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
মানবতাবাদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে। এর সাধারণ ভিত্তি হলো মানুষকে জ্ঞানের মূল কেন্দ্র হিসেবে গণ্য করা।
১. যুক্তিবাদী মানবতাবাদ: এটি যুক্তি, বিজ্ঞান এবং মুক্তচিন্তাকে অগ্রাধিকার দেয়। এটি বলে যে, মানব জাতির উন্নতি অর্জনের জন্য অলৌকিকতার প্রয়োজন নেই।
২. নৈতিক মানবতাবাদ: এটি নৈতিকতার ভিত্তিতে সমাজ গঠনের কথা বলে। এটি মানুষের মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারকে গুরুত্ব দেয়।
৩. ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ: এই দর্শনটি মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে সর্বোচ্চ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং অতিপ্রাকৃত শক্তির ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে।
৪. ধর্মীয় মানবতাবাদ: যদিও এটি অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে, এটি মানবিক মূল্যবোধ, সহমর্মিতা এবং নৈতিকতার প্রচার করে।
মানবতাবাদের প্রাথমিক ধারণাগুলি প্রাচীন গ্রীসে বিকশিত হয়েছিল। প্রাক-সক্রেটিস দার্শনিক থেলিস ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি যুক্তির মাধ্যমে প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তিনি প্রথাগত ঈশ্বরকেন্দ্রিক বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। এর ফলে গ্রীক মানবতাবাদ একটি নতুন মনোভাব গড়ে তোলে, যেখানে মানুষই সৌন্দর্য, ন্যায় এবং সত্যের মাপকাঠি।
ভারতে লোকায়ত দর্শন এবং বৌদ্ধধর্মেও অলৌকিকতার প্রতি সংশয় প্রকাশ করা হয়েছিল। গৌতম বুদ্ধ এবং কনফুসিয়াস ধর্মনিরপেক্ষ নৈতিকতার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে রেনেসাঁর সময় মানবতাবাদের একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়। দান্তে, পেট্রার্ক এবং এরাসমাসের মতো চিন্তাবিদেরা মানবিক জ্ঞান এবং শিল্পচর্চায় নতুন প্রাণসঞ্চার করেন।
এই সময়ে ধর্মীয় কর্তৃত্বের চেয়ে ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং মানব ক্ষমতার ওপর জোর দেওয়া হয়। গ্যালিলিও এবং কেপলারের মতো বিজ্ঞানীরা মানবতাবাদের চেতনাকে বিজ্ঞান ও যুক্তির দিকে প্রসারিত করেন।
আজকের মানবতাবাদ একটি বহুমাত্রিক ধারণা। এটি কেবল যুক্তিবাদ এবং নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং পরিবেশ রক্ষার ওপরও গুরুত্বারোপ করে।
মানবতাবাদ মানুষকে একত্রে কাজ করার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার এবং একটি শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়পূর্ণ সমাজ গড়ার শিক্ষা দেয়। এটি বলে যে, মানুষের মঙ্গলই সব কিছুর শীর্ষে।
চন্ডীদাসের "সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই" থেকে নজরুলের "গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই" পর্যন্ত—মানবতাবাদের বাণী চিরন্তন।
আজকের পৃথিবীতে, যেখানে বৈষম্য, সহিংসতা এবং সংঘাতের প্রাচুর্য, মানবতাবাদ আমাদের মনে করিয়ে দেয় মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব। এটি আমাদের বলে, আমরা একত্রে কাজ করলে একটি সুন্দর, ন্যায়ভিত্তিক, এবং টেকসই পৃথিবী গড়তে পারি।
মানবতাবাদ এক অর্থে কেবল আদর্শ নয়; এটি মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার এক অনন্য চিত্র। এটি আমাদের আত্মাকে উজ্জীবিত করে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উজ্জ্বল পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়। এটি একটি শাশ্বত আহ্বান: মানুষ হও, মানবতার সেবক হও।